সাধনা’ ও ‘সিদ্ধি’ বস্তু দুটি কি? ইহা আমাদের ভালো করে জেনে নেওয়ার দরকার। প্রথমত ‘সাধনা’ অর্থাৎ অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাইবার জন্য যে পরিশ্রম বা যে কাজগুলো সম্পাদন করা হয়, তাহার নামই হলো ‘সাধনা’। তরীকতের ভাষায় ইহাকে ‘রিয়াযত মুশাহেদা’ বলা হয়। আর ‘সিদ্ধি’ হলো আমি যেই বস্তু লাভের জন্য রিয়াযত করিতেছি, সেই বস্তু পূর্ণভাবে হাসেল করিতে পারা।
এখন আলোচ্য বিষয় হলো, আমরা এই ধারাধামে এসেছি, আবার এই ধরাধাম হইতে চলে যাব। কেনোই-বা এলাম আবার কেনোই-বা চলে যেতে হবে। ভাবলে অবাক লাগে। আমরা ছিলাম কোথায়? এলাম হেথায়, আবার যাব-ই-বা কোথায়? যে দেশে যেতে হবে, সে দেশ কত দূর? সেই দেশের ভাব কি? সেই দেশের মালিক কে? তাঁর সাথে আমার কি সম্বন্ধ? আমি কি নিয়ে এসেছিলাম? আবার কি নিয়ে দেশে ফিরে যাব?
আল্লাহ্ পাক কোরআন মাজিদে বলিয়াছেন, “ওয়া’মা খালাকতুল জ্বিন্না ওয়াল ইন্ছা ইল্লা লি ইয়াবুদুন”। অর্থাৎ ‘আমি জ্বীন আর ইন্ছান বানাইয়াছি শুধুমাত্র আমার এবাদতের জন্য বা দাসত্বের জন্য, আর কিছুর জন্য নয়।’ কোরআন মাজিদে আল্লাহ্ পাক আরও বলেন, “ইয়া আইয়ুহান্ নাফ্সুল মোৎমাইন্নাহ্ ইরজী ইলা রব্বিকা রদিয়াতাম্ র্মাদীয়াহ্”। অর্থাৎ ‘হে নফ্সে মোৎমাইন্না স্বীয় প্রভুর পানে ফিরিয়া যাও। তুমি তাঁহার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁহা হইতে সন্তোষ প্রাপ্ত অনন্তর আমার দাসগণের অর্ন্তভূক্ত হও এবং আমার স্বর্গে প্রবেশ কর।’
মূলত এই প্রসঙ্গাটাই হলো সাধনার প্রসঙ্গ। আর একজন আত্মজ্ঞানী হাক্কানী গুরু বা মুর্শিদের সঙ্গ ধরে জানতে হয় যে, আমি কে? আমি কোথায় ছিলাম? আমার দেশ কোথায়? আমি মানবরূপে এই ধরাধামে কেনোই বা এলাম? আবার কেনোই বা চলে যাব? এই আসা যাওয়ার উদ্দেশ্য-ই বা কি? আমার এই আসা যাওয়ার অবসান কবে হবে? আমার মালিক কোরআন নামক চিঠি দিয়ে আমাকে জানাইলেন, আমাকে নাকি এবাদত করিতে পাঠাইয়াছেন। জানতে পারলাম এবাদত অর্থ মালিকের দাসত্ব করা। আমি সেই দাসত্ব কিভাবে আদায় করবো? আমার সেই মালিক কোথায়? তাঁকে আমি কিভাবে কোথায় গিয়া সন্ধান করবো বা তালাশ করবো?
একজন পূর্ণ আত্মজ্ঞানী কামেল মুর্শিদই এই সকল প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন এবং ইহার সমাধানের উপায় বাতাইয়া ভক্তকে আত্মজ্ঞানের দ্বারা খোদাকে চিনা জানা করাইয়া ভক্তকে মক্সুদ মঞ্জিলে পৌঁছাইবার জন্য এবাদতের পূর্ণ বিধান বা সাধনার পূর্ণ জ্ঞান দান করিয়া একজন মানবকে আল্লাহ্র পেয়ারা বান্দা বা অলিয়তির দরজায় পৌছাইয়া দিতে পারেন। ইহা কিতাব পড়িয়া কখনো অর্জন করা সম্ভব নয়। এই দুনিয়ার যত বড় আলেম ওলামা হোক না কেন, মুর্শিদ বিহনে কারো পক্ষে আত্মজ্ঞান বা আল্লাহ্র মারিফত হাসেল করা সম্ভব নয়। আর মারিফত বিহনে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করা সম্ভব নয়। তাই এই দুনিয়াতে পীর বা মুর্শিদের নিকট আত্মসমর্পন ব্যতিত কেহ অলিয়তি প্রাপ্ত হয়েছে, এমন কোনো নজির নাই।
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী (রঃ) বলেছেন, “হরগিজ না শোদ্ মৌলায়ে রুম, তা গোলামে শাম্স তাব্রেজী না শোদ্”। অর্থাৎ ‘আমি কখনোই মৌলায়ে রুম হইতে পারতাম না। যদি আমি হযরত শামস তাবরেজী (রঃ) এর গোলামী স্বীকার না করিতাম।’ আবার ইমামে আজম হযরত আবু হানিফা (রঃ) তিনার কিতাবে বলেছেন, “আমি নোমান ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে যাইতাম, যদি আমি হযরত বাকের (রঃ) এর নিকট আত্মসমর্পন না করিতাম (হযরত আবু হানিফা (রঃ)এর ছোটবেলা হইতে ডাকনাম ছিল নোমান)।” এই দুইটি দলিল না দিলেই নয়, তাই উল্লেখ করিলাম। অতএব পীর বা মুর্শিদের কৃপা বিহনে এই দুনিয়াতে কেউ ওলী হইতে পারবে না এবং পরকাল মুক্তি ও আল্লাহ্র দিদার লাভ করিতে পারবে না। ইহা প্রমানের জন্য অসংখ্য দলিল আমাদের কাছে রয়েছে এবং অসংখ্য ছুফী মতবাদের কিতাবে বহু জ্ঞানীজনেরা অসংখ্য দলিল উল্লেখ করিয়াছেন। আমি শুধু এতটুকুই বলতে চাই, আল্লাহর এবাদত করিয়া আল্লাহকে রাজী খুশি করিতে হইলে একজন আত্মজ্ঞানী কামেল মুর্শিদের আশ্রয় অবশ্যই নিতে হবে। কারণ তিনিই ভক্তের মুক্তির দিশারী। তিনিই বলে দিবেন ভক্তকে মুক্তির সন্ধান।
সেই মুক্তির দেশ কোথায় এবং কতদূর? সে দেশে পৌছাইবার জন্য কয়টি রাস্তা বা কয়টি পথ অতিক্রম করতে হবে? আর কোন পথটি সব চাইতে উত্তম? আর কোন পথে চলিলে আমি সহজে মুক্তির দরজায় পৌছাইতে পারব? আর সেই পথে চলার জন্য আমার কী করণীয়? পথ চলিতে চলিতে যদি কখনো বিপদ আসে তখন আমাকে কে সাহায্য করিবে? আমার মন বড় চঞ্চল। আমার মন যদি আমার সাধনার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন আমি কিভাবে আমি আমার মনকে আমার বশে বা অধীন করিতে পারব? কিভাবে আমি বহু দিনের রাস্তা কোন সাধনায় অল্প দিনে পাড়ি দিতে পারবো?
এই সকল তত্ত্ব ও তথ্য একজন জাননেওয়ালা পূর্ণজ্ঞানী গুরু বা হাক্কানী কামেল পীরের নিকট হতে জানা দরকার। তিনিই জানেন তাঁহার কোন ভক্তের জন্য কোন পথটি সহজ এবং উপযোগী। তিনি আরও জানেন কোন সাধনায় বহুদিনের রাস্তা অল্প দিনে পাড়ি দেওয়া যায়। একমাত্র গুরুই ইহা জানেন এবং গুরুই নির্ণয় করবেন যে, তাঁহার কোন ভক্ত কোন সাধনার উপযোগী। একনিষ্ঠ ভাবে প্রত্যেক ভক্তের উচিত তাঁর গুরু তাকে কোন পথে চলার জন্য নির্দেশ করেন, বিনা দ্বিধায় বিনা সংকোচে একাগ্রচিত্তে উহা পালন করা প্রত্যেক ভক্তের অবশ্যই করণীয়। গুরুতে পূর্ণ বিশ্বাস, ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমে তাঁহার সমস্ত আদেশ, উপদেশ একাগ্রচিত্তে পালন করিয়া গুরুর মন জয় করিতে পারলেই দ্বীন বন্ধু দয়াল গুরুর কৃপায় সকল সাধনায় জয় হওয়া সম্ভব।
গুরুকে গোবিন্দ জ্ঞানে না বিশ্বাস করিয়া; বরং ‘গুরুই গোবিন্দ’ ভাবিয়া যে ভক্ত গুরুর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করিতে পারিয়াছে, সেই ভক্তের আর কোনো ভয় নাই। গুরু যাহার সহায় হয়েছেন সেই শুধু সাধনায় জয় লাভ করিয়া সিদ্ধি লাভ করিতে সক্ষম হয়েছে। তাই মোজাদ্দাদে আল্ফেছানী (রঃ) বলেছেন, ”পীরে তাস্ত আওয়াল মাবুদ তাস্ত” অর্থাৎ তোমার পীরই তোমার প্রথম মাবুদ। (গ্রন্থঃ মালাওল উলুম)
“সাধনা” নামটি শুনতে ছোট শোনা গেলেও সাধনার বিষয়টি অনেক বড়। সাধনার পথে অনেক বাঁধা এবং পূর্ণ জ্ঞান না থাকিলে সাধনার অবস্থায় সাধনাকারীকে অনেক বড় বড় উত্থান পতনের সম্মুখীন হইতে হয়। সাধনার পথে অনেক ভক্ত বা ছালেকগণ সাধনায় বসিয়া সামান্যতম উন্নতির পথে অগ্রসর হইয়া ঝরাকে শরা জ্ঞান করিয়া অহংকারে মত্ত হইয়া পরে। আবার কেহ কেহ পাগলের প্রলাপের ন্যায় অতি রঞ্জিত কিছু কথা বলিয়া মানুষের মন নিজের দিকে আকৃষ্ট করিবার চেষ্টা করিয়া থাকে। আবার এমন কেহ আছে, সাধনায় বসার পর ছালেক যখন লাওয়ামা হইতে মোল্হেমার দিকে ধাবিত হয় তখন ছালেকের সামনে অনেক মনোরম দৃশ্য উপস্থিত হইতে থাকে। এমন কি অনেক সময় অনেক ওলিদের সাথেও রুহানী ভাবে সাক্ষাত হয়ে যায়। এই অবস্থায় অল্প জ্ঞানী ছালেক মনে করে ‘আমি পেয়ে গেছি বা হইয়া গেছি’। আবার কেউ আকাশে উড়িয়া বেড়ায়। সাধনার প্রথম ধাপে এই ধরনের কিছু আনন্দদায়ক ঘটনা ঘটিতে থাকে। এই জন্য ঐ সকল ছালেকগণ সাধনার পূর্ণ জ্ঞান না থাকার কারণে সাধনার শুরুতে থেমে যায়। তাদের বড় দূর্ভাগ্য। এই অবস্থায় পূর্ণ জ্ঞানী গুরুই হলো একমাত্র উপায়। যাহার গুরু কামেল বা সাধনার সকল ধাপের অবস্থা এবং ব্যবস্থা জানেন, শুধু ঐ গুরুই সেই ভক্তকে ঐ অবস্থা থেকে উন্নত ধাপে পৌঁছাইয়া দিবার ক্ষমতা রাখেন বা আগাইয়া দিতে পারেন। এই জন্য সাধনায় বসার পর ভক্তের কখন কি ভাবের উদয় হয়, তা গুরুকে জানানো দরকার। তখন গুরুই সেই ভক্তের ঐ অবস্থার পরিবর্তন আনিয়া তাহার লক্ষ্য স্থির করিয়া দিবেন। এই ভাবেই গুরুর কৃপায় সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব।
সাধনার শুরুতেই প্রত্যেক ভক্তের জীবনে আর একটি কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাহা হলো ‘মনের চঞ্চলতা’। এই চঞ্চল মন সাধনায় বসিতে চায় না। ‘নফ্স’ নামক শয়তান সর্বদাই মনের পিছনে লেগে থাকে। ধ্যান বা মুরাকাবায় বসলে ছালেকের মনে দুনিয়াবী বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা জাগ্রত করে মনকে চঞ্চল করিয়া তুলে। জীবনে কখন কি ঘটেছিল সেই সব স্মৃতি বিজরিত অনেক ঘটনা, অনেক কথা, দুঃখ-বেদনা-সুখ এই ধরনের অনেক দৃশ্য এসে মনকে চঞ্চল করে তুলে। সাধক বারবার মনকে ধ্যানে লাগাইবার চেষ্টা করা স্বত্ত্বেও মন স্থির হয় না। মন লাগামহীন এক পাগলা ঘোড়ার মত দৌড়াইতে থাকে। কখনো এদিক বা কখনো ঐ দিক ছুটাছুটি করতে থাকে। শত বুঝাইলেও মন বুঝ মানে না। কারণ মনের স্বভাবই চঞ্চল।
আমাদের দেহে নফ্সে আম্মারা বলে একটি নফ্স রয়েছে। উহা আমাদের দেহের পাঁচটি নফসের একটি। এই নফ্সটি সাধকের সাধনার পথে সবচাইতে বড় বাধা। এই নফ্সের অধীন ষড়রিপু। এই ষড়রিপুই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করিয়া মনকে নফ্স আম্মারার অধীন করিয়া রাখে। তাই মন সাধকের হওয়া স্বত্বেও নফসের তাবেদারী করে থাকে এবং সাধনাকারীর সাধনায় ধোঁকা দেয়। রিপু সর্বদাই মনকে চঞ্চল করিয়া রাখে। সাধক আল্লাহকে পাওয়ার জন্য বা দেখার জন্য ভাব দরিয়ায় বা ধ্যানে ডুব দিতে পারে না। দুনিয়াকামী মন সাধককে দুনিয়ার দিকে টেনে রাখে। এই অবস্থায় অনেক আশেকী প্রেমিক ভক্ত বা ছালেক নিজেকে অনেক গুনাহ্গার বা অপরাধী বলে ভাবিতে থাকে। আসন ছেড়ে উঠে যায়। পেরেশানীতে কাল যাপন করিতে থাকে। অনেক ভক্ত যাহারা প্রকৃত আশেকান, তাহারা ভাব আবেগে আপন মনে গুণ গুণ সুরে প্রার্থনামূলক গান গাইতে থাকে, আর নিজের মনকে ধীক্কার দেয়। সাধনার প্রথম অবস্থায় সবারই এই একই অবস্থা বা একই দশা। কিন্তু যাহার ভাগ্য ভালো শুধু তাহারই একজন কামেল মুর্শিদ নছিব হইয়েছে। সেই শুধু সাধনার জগতে গুরুর কৃপায় সাধনার শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সফলকাম অর্জন করিয়া সিদ্ধির দেশে পৌঁছাইতে পেড়েছে। সে বড় ভাগ্যবান।
বর্তমান দুনিয়ায় ইসলামী ছুফী মতবাদের উপর বিভিন্ন তরীকাভূক্ত অনেক পীর মোশায়েখগণ বিভিন্ন ভাবে পীরগিরী করিতেছেন। কিন্তু দেখা যায় এদের মধ্যে এমনো কতক পীর সাহেবেরা আছেন যে পীরগিরি কি বস্তু তাহাই বুঝে না। আত্ম জ্ঞান তো দূরের কথা, আত্মজ্ঞান যে কি বস্তু তাহাও জানে না। কিছু ফেক্রা কথা শিখে লয়েছে, সেই সব ফেক্রাদারী কিছু কথা বলে মানুষকে মত্ত্ব করে নিজেকে জাহের করে হাক্কানী কামেল পীর রূপে পরিচয় দিয়ে সহজ সরল অনেক আল্লাহ্র আশেকান বান্দাদেরকে মতি ভ্রমিত করিয়া মুরিদ করিতেছে। কথায় বলে “ভাঙ্গা একখান নাও, নাম রাখছে ময়ূরপঙ্খী”। এইসব নৌকাতো ডুববেই এবং যাহারা ঐ সব নৌকার যাত্রী হবে, তাদের কপালেও দুর্গতি অনিবার্য। তাই মাওলানা জালালদ্দিন রুমী (রঃ) বলেছেন, “ভ্রান্ত পীরেরা বিষাক্ত সাপের চাইতেও ভয়ংকর বা বিপদজনক”। দয়াময় আল্লাহ্ পাক যেন ঐসব পীরগণকে হেদায়াত নসীব করেন। আর এদের সহজ সরল মুরিদগণকে যেন আলাহ্ পাক ক্ষমা করিয়া একজন প্রকৃত আল্লাহওয়ালা পীরের নিকট আশ্রয় দান করেন। আমিন।।
আমাদের ছুফী মতবাদের সকল পীর মোশায়েখগণ তিনাদের সকল ভক্তদের এবাদত বন্দেগী করার উদ্দেশ্যে আল্লাহকে রাজি খুশি করার জন্য ও পরকালের মুক্তির উদ্দেশ্যে সকল মুরিদগণকেই যার যার জ্ঞান অনুসারে, ভক্তকে সাধনা ও সিদ্ধি লাভের উদ্দেশ্যে ভক্তদেরকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে তপ-জপ, মোরাকাবা মোশাহেদা বা ধ্যান শিক্ষা দিয়ে থাকে। আমরা সবাই মুরিদগণকে বলে থাকি ‘‘হে মুরিদগণ বা ভক্তগণ! তোমরা জিকিরেতে মন লাগাও, ধ্যানে মন লাগাও”, বাস্তবে মন লাগাইতে বললেই কি ধ্যানে মন লাগে!!! ইচ্ছা করলেই কি সবাই ধ্যানে মন লাগাতে পারে?। নিশ্চয়ই সবাই মন লাগাইতে চাইলেও মন এত সহজে লাগে না। যাদের মন চঞ্চল তারা সাধনায় সফল হতে পারে না। তাই অবাধ্য মনকে নিজের বসে আনতে হয়। কোন সাধনার দ্বারা মনকে স্থির করে সাধন পথে ভক্তকে সফলকামী হিসেবে গড়ে তুলা যায়, ইহা গুরুর দায়িত্ব। ভক্তকে সাধনায় বসাইবার আগে কিভাবে মন বসে আনা যায় সেই সাধনা শিক্ষা দিয়া তারপর সিদ্ধি লাভের জন্য সাধনায় বসাইতে হয়। ইহা হল পীরগীরি বা গুরুগীরির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য হল কামেল পীরের প্রধান লক্ষন। তত্ত্ব জানলেই পীর হওয়া যায় না। তত্ত্ব জ্ঞান হল ভক্তের ঈমান মজবুত করার জন্য। আর সাধনা হল সিদ্ধি লাভের জন্য। আশাকরি জ্ঞানীজন আমার এই অল্প কয়েকটি কথার দ্বারা বুঝতে পেরেছেন। মূলত মনকে বসে আনিতে পারা বা মনকে বাধ্য করিতে পারাই হল সাধনার জগতের মূল সাধনা, এটা আমি মনেকরি। এই মন কোন সাধনা দ্বারা বশে আনা যায় এবং মন বশে আসিলে এই মন সাধনাকারীকে কেমন ভাবে সাহায্য করে, কতদূর পর্যন্ত সাহায্য করিতে পারে, এখন আমি সেই ব্যাপারে মোটামোটি একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।
চিত্তের প্রবৃত্তিকে নিবৃত করার নাম হল প্রধান সাধনা’। মন বসে আসিলে সর্ব সাধনায় সিদ্ধি লাভ হয়। এই মনকে বশে আনার জন্য বিভিন্ন ধর্মের সাধু-গুরু-বৈষ্ণব, মনি-ঋষি, অলি-আল্লাহ, গাউছ-কুতুব বা আল্লাহর ফকিরগণ বিভিন্ন পদ্ধতি বলে গেছেন। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে আমার মতে যাহা সর্বশ্রেষ্ঠ মনে হইয়াছে আমি উহাই এই কিতাবে বলিতে বা বুঝাইতে চেষ্টা করিতেছি। উহা হল “দমের সাধনা”।
এই দমের সাধনাকে যোগী মনি ঋষিগণ “প্রাণায়াম” নামে আখ্যায়িত করে গেছেন। আবার এই প্রানায়ামকে আবার কয়েক ভাগে ভাগ করিয়া কার্য অনুসারে কয়েকটি নাম দেওয়া হয়েছে। যেমনঃ-
১। কুম্ভুক প্রানায়াম। ২। অলোলোম বিলোম প্রানায়াম।
৩। কাপিল ভাতি প্রানায়াম। ৪। ভুহ্ম্রা প্রাণায়াম ইত্যাদি।
এইগুলো সবই দমের সাধন। আমি মনে করি, এই সব দমের সাধনাই হল সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা। এই সাধনার দ্বারা সাধক বহু জন্মের সাধনার ফল এক জন্মেই লাভ করিয়া জন্ম আর মৃত্যুকে জয় করিতে সক্ষম হন। এই মাটির মানুষ আল্লাহর শক্তিতে শক্তিমান হয়ে বাকাবিল্লাহ্র ওলি বা গাউছ কুতুবগণের দরজায় পৌছায়তে পারেন। ইহা আমার ধারণা , অন্যদের ধারনা বলিতে পারি না। যাই হোক, আমার অভিজ্ঞতার আলোকে যাহাই বলতেছি বা লেখতেছি ইহা অব্যর্থ। এই জ্ঞান অর্জন করিয়া পরীক্ষা করিলে বুঝতে পারিবেন যে, দমের সাধনার কত শক্তি। এই দমের সাধনাকে আল্লাহ্র অলি, ফকিরগণ ‘পাঁছ আনফাছের সাধনা’ নামে আখ্যায়িত করেছেন।
মনকে বশে আনার জন্য দমের সাধনা বা ‘পাঁছ আনফাছের সাধনা’ই হল প্রধান সাধনা বা প্রধান উপায়। তবে দমের সাধনার মধ্যে ‘কুম্ভুক’ হল সর্বশ্রেষ্ঠ। আর কুম্ভুক প্রাণায়ামকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ
১। অন্তঃর কুম্ভুক। ২। বহিঃর কুম্ভুক।
এই ‘কুম্ভুক’ সাধনা আপন গুরুর কাছে থেকে শিক্ষা লাভ করতে হয়। ইহার নিয়ম বা বিধান রয়েছে। সেই নিয়ম বিধান ছাড়া কেউ যদি এই সাধনা করে, তবে সাধনাকারীর ঐ সাধনায় কোনো ফল পাবে না। বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। এর জন্য একজন পূর্ণজ্ঞানী কামেল মুর্শিদের আশ্রয় নিতে হবে।
আমি ইতিপূর্বে পীর সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেছি। হয়তো এধরনের পীর সাহেবরা আমার এই কিতাবটি পড়িয়া অনেক রাগ হয়ে যাবেন। আমি কিন্তু কাউকে ছোট করার জন্য এই কথাগুলো লেখি নাই। বাস্তবে পীর সম্বন্ধে আমি যাহা বলেছি বা লেখেছি, তার কারণ হল কোনো লোকই যেন পীরগিরীর পূর্ণ আত্মজ্ঞান আর সাধনার জ্ঞান অর্জন না করিয়া পীরগিরী করার জন্য লালায়িত না হয়। দুনিয়ার সহজ-সরল আল্লাহ্র আশেকান বান্দারা যেন ধোকা প্রাপ্ত না হন। তাহারা যেন সত্যিকারের একজন কামেল মুর্শিদের নিকট পৌঁছাতে পারেন এবং দয়াল গুরুর কৃপা লাভ করিয়া সাধনা ও সিদ্ধির দেশে পৌছাইতে পারেন। দয়াময় আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ করিয়া এই মানব জনম সার্থক করিতে পারেন। ধোঁকাবাজীর দরবারে গিয়ে কেউ কোনো দিন আল্লাহ্ প্রাপ্তি হতে পারে না। আমার দ্বীনের নবী বলেছেন যে, “আল হাক্কু কররুন”- অর্থাৎ ‘‘হক কথা তিতা বা করা শুনা যায়”।
আমি এখন আবার পুনরায় পূর্বের কথায় ফিরে আসি। দমের সাধনাই হলো মনকে বশে আনার প্রধান সাধনা বা উপায়। দমের সাধনা দ্বারা মনকে বস করা যায়; শুধু তাই নয়, এই দমের ঘর আল্লাহ্র ফকিরদের ‘ফকিরী ঘর’। এই দমের ঘরে প্রবেশ করিয়া ফকিরগণ ফকিরী করিয়া এই দুনিয়ার অনেক আগুম-নিগুম সম্বন্ধে অগ্রিম খবরও জানতে পারেন। মোট কথা, এই দমের ঘরে প্রবেশ করিয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রেমিক সাধকগণ ফকিরী করিতেছেন।
এই দম বা শ্বাস প্রশ্বাসের দ্বারা কুদরতময় মহান আল্লাহ্ পাক এক বিশাল আজব কুদরতী ঘর নির্মাণ করিয়াছেন। ইহা পূর্ণ জ্ঞানী আরেফ বিল্লাহ্ ফকির যাহারা, তাঁহারাই বুঝতে পেরেছেন। এই মানব রূপী দেহ ঘরটি আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি। যাহা আছে এই ব্রোহ্মান্ডে, তাহা আছে এই মানব দেহ ভান্ডে। এই দেহ ভান্ডে দিবা রাত্রী ২৪ ঘন্টার মাঝে ১২ বার দিন আর ১২ বার রাত তথা চন্দ্র-সুর্য, গ্রহ-নক্ষত্র উদয় অস্তিমিত হইতেছে। অর্থাৎ ১২ বার রবি-শষী উদয় আর অস্তিমিত হইতেছে। প্রতি মুহুর্তে ১২ বারুজ ৭ সেতারার অনন্ত অসীমের এক আজব খেলা চলিতেছে। এই খেলা প্রত্যেকটি মানবদেহে সংগঠিত হইতেছে। যাঁহারা পূর্ণ আত্মজ্ঞানী আরেফ বিল্লাহ্, তাঁহারা আল্লাহ্র এই সব নিগুম খেলা দেখতে দেখতে এক মহা আনন্দের সাগরে ভাসিয়া বেড়াইতেছেন। ইহা দুনিয়াদার মানুষের উপলব্ধি করার ক্ষমতা নাই। মানবের এই দেহ এক অনন্ত রহস্য ভান্ডার। এইসব রহস্যের মধ্যে ‘দমের ঘর বা পাছ আনফাছ’এর রহস্যটাই হল সব চাইতে গভীর রহস্যপূর্ণ। এই দমের ঘরেই ‘সুলতান নাছিরা’ পথে পাছ আনফাসের সাথে আল্লাহ্ ও আদম আর দ্বীনের নবী সর্বক্ষণ আসা যাওয়া করেন। এই দমের ঘরেই আহাদি, আহ্ম্মাদি আর মোহাম্মাদি শক্তি দ্বারা সমস্ত প্রাণী জগত জীবিত এবং পরিচালিত হইতেছে। এই জগৎময় সর্ব চীজে সর্ব ভুতে আমার ঐ আল্লাহ্ পাকের কুদরতী শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রীত ও পরিচালিত হইতেছে। প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে সর্ব কিছুর মূলে রহিয়াছে আমার ঐ আল্লাহ পাকের কুদরতী এক নিগূম খেলা। আরিফ বিল্লাহ্ ছাড়া ইহা অন্য কেহ বুঝিতে পারে না। উলুহিয়াত দরিয়ার মাঝে খোদার নিজ কুদরতে রূবুবিয়াত রূপে এক অনন্ত তরঙ্গ রাশির যোগ মিলনে তথায় হু-হু-হু এর অনাবিল এক শান্তির ধ্বনি উচ্চারিত হইতেছে। ঐ ধ্বনি আরেফ বিল্লাহ্গণ নিজ নিজ কর্ণে শ্রবণ করিতে করিতে ভাব আবেগে বিভোর হয়ে খোদার অনন্ত কুদরতময় আবুদিয়াত নামক ভাঙ্গা গড়ার খেলার কৌশল দেখিতে দেখিতে রিপু এবং ইন্দ্রীয় ভিত্তিক আনন্দ পরিত্যাগ করিয়া এক অনন্ত অনাবিল আনন্দের সাগরে ডুব দিয়া অনেক সময়ের জন্য সমাধি প্রাপ্ত হইতেছেন। আর এই হু-হু-হু এর ধ্বনিকে আরেফ বিল্লাহ্দের ভাষায় ‘আন্হাদ-নাদ’ বলা হয়। এই ধ্বনিকে যোগী মনি-ঋষীগণ ‘ঔঁ-কার নাদ’ বলিয়া আখ্যা দিয়েছেন। কৃষ্ণ ভক্তরা ঐ শব্দকে ত্রিবেনীর ঘাটে কৃষ্ণের ভাবের বাঁশির মধুর ধ্বনি বলিয়া থাকে। উহা এক অনন্ত মধুর সুর। ঐ সুর বা ধ্বনিতে যে আনন্দ লুকাইয়া রহিয়াছে সেই আনন্দকে ব্রহ্মানন্দ বলিয়া যোগী মণি-ঋষীগণ আখ্যায়িত করেছেন। ব্রহ্মানন্দ হল যে আনন্দের কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, শুধু সেই বুঝেছে যেজন ঐ আনন্দের দেশে পৌঁছাইয়াছেন।
একজন আত্মজ্ঞানী হাক্কানী কামেল মুর্শিদ তিনার ভক্তকে আত্মজ্ঞান দান করিয়া দমের সাধনা শিক্ষা দিয়া ত্রিবেনীর ঘাটে খাড়া করে ঐ আনহাদ-নাদ শুনাইয়া আল্লাহ্র মহাব্বতে সমাধিস্ত হওয়ার পদ্ধতি বা সাধনা শিক্ষা দিয়া ভক্তকে ওলীর দরজায় পৌছাইয়া দিতে পারেন। যদি দ্বীনবন্ধু দয়াল গুরু কৃপা করেন। একজন ছালেক দমের সাধনা দ্বারা মনকে বশে আনিয়া সকল সাধনায় জয় করে সিদ্ধি লাভ করতে পারে। আর যদি মনকে বশ না করতে পারে, তাহলে সেই ব্যাক্তি যতই সাধনা করার চেষ্টা করুক না কেন নিশ্চয়ই সে ব্যর্থ হবে, তাহার সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব হবে না। তাহার এই দুর্লভ মানব জীবন ব্যর্থ হবে। তাই আমি মনে করি, আল্লাহ্র দিদার লাভ করিতে চাইলে বা সাধনায় সিদ্ধি লাভ করিতে চাইলে প্রথমেই মনকে নিজের বশে আনতে হবে তারপর মনকে সাধনার সঙ্গী বানায়ে মনের সহযোগিতায় সাধনায় বসে সিদ্ধির দেশে প্রবেশ করিতে হবে। তাই আমি মনে করি, প্রত্যেক আশেকানের উচিত দমের সাধন শিক্ষা লাভ করিয়া আগে মনকে নিজের বশে আনা দরকার, তারপর ধ্যান বা মোরাকাবা-মোশাহেদায় প্রবেশ করিয়া সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব। তা না হলে ভজন সাধন ব্যর্থ হবে। এটি আমার মতামত, অন্যেরা কি ভাবে সেটা তাদের ব্যাপার।
এখন আমি দমের সাধনা বা পাছ আনফাসের সাধনার সার্থকতা সম্পর্কে আরো কিছু আলোচনা করব। যাহা অনেক কিতাবে অনেক জ্ঞানীগণ আলোচনা করেন নাই বা লেখেন নাই। আমি এই জন্য আলোচনা করিলাম, যাতে করে দুনিয়ার মানুষেরা এই বিষয় ধারণা নিয়ে ইহলোক ও পরলোকের জন্য মঙ্গল সাধন করিতে পারে এবং উপকৃত হতে পারে। প্রথমে আমি এই শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের জীবনের আয়ু বা পরম আয়ু ঘাটতি হইতে বৃদ্ধির দিকে নেওয়া যায়, সেই সম্মন্ধে অবগত করাইবার চেষ্টা করিবো। যাহারা জ্ঞানী ও সচেতন মানুষ, তাহারা আমার এই শ্বাস-প্রশ্বাসের তথ্য হইতে অনেক কিছু জানিয়া ও বুঝিয়া লাভবান এবং উপকৃত হইতে পারিবেন।
আল্লাহ্ পাক এই শ্বাস-প্রশ্বাসের দ্বারা প্রত্যেকটি প্রানী ও মানুষকে তার পরম আয়ু নির্ধারন করিয়া দিয়াছেন। উদাহরণ দ্বারা বুঝাইতে চেষ্টা করিতছি। মনে করুন, মানুষ একটি আগের দিনের চাবিওয়ালা ঘড়ির ন্যায়। আমরা দেখেছি ঐ ঘড়িটি একবার চাবি দিয়ে রাখলে বা ব্যবহার করিলে যতক্ষন ঐ ঘড়িটি চাবি অবস্থায় থাকে ততোক্ষণ ঘড়িটি টিক্ টিক্ টিক্ করিয়া চলিতে
থাকে। মনে করুন একবার চাবি দিলেই ২৪ ঘন্টা চলতে থাকে। কিন্তু চাবিটি শেষ হলেই ঘড়ি বন্ধ হয়ে যায়। আবার চাবি দিলে আবার চলতে শুরু করে। এই ভাবে দিনের পর দিন চাবি দিয়ে চালাইতে হয়। তেমন আমাদের মানবদেহ ও একটি চাবিওয়ালা ঘড়ির ন্যায়। দয়াময় আল্লাহ পাক আমাদের দেহ ঘড়িটিতে শ্বাস প্রশ্বাস নামক এক চাবি দিয়ে পাঠাইয়া দিয়েছেন এই দুনিয়াতে। যতদিন শ্বাস প্রশ্বাস নামক চাবিটি আছে ততদিন আমরা চাবিওয়ালা ঘড়ির ন্যায় টিক্ টিক্ টিক্ না বলে আর্মা আর্মা আর্মা বলে জীবন কাটাইতেছি। আর এই চলার নামই হচ্ছে জীবন। আর যেই দিন শ্বাস-প্রশ্বাস নামক চাবিটি শেষ হয়ে যাবে তাহার নাম মরণ, পার্থক্য হলো দুনিয়ার ব্যবহৃত ঘড়িটির মালিক যদি আবার চাবি দেয়, তবে ঘড়িটি আবার পুনরায় চলিতে থাকবে। আর আমাদের দেহরূপী ঘড়িটির মালিক স্বয়ং আল্লাহ্। মানবের দেহ ঘড়িটি দ্বিতীয় বার চাবি দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা বা উপায় নাই। তবে উপায় একটি আছে, সেই উপায় দ্বারা কোনো কোনো যোগী, মনি, ঋষী, জ্ঞানীজন হাজার বছর এই দুনিয়াতে বেঁচে ছিলেন এবং এখনো অনেক আল্লাহ্র ফকির জ্ঞানীজন বেঁচে আছেন এবং বাঁচতেছেন।
শাস্ত্র মতে ২১ হাজার ৬০০ বার দিবা রাত্রি ২৪ ঘন্টাতে শ্বাস-প্রশ্বাস আসা যাওয়া করে। এই শ্বাস-প্রশ্বাসকে গুরুজ্ঞান অর্জন করিয়া যে যতটুকু কমিয়ে নিতে পারবে সে ততোটুকুই পরম আয়ু বাড়াইয়া নিতে পারবে। উহা শাস্ত্র সম্মত বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছি। মানুষ যখন চুপচাপ বসিয়া থাকে তখন মানুষের প্রাণ বায়ু ১০ আঙ্গুল পরিমাণ ভিতরে প্রবেশ করিয়া আবার ১২ আঙ্গুল পরিমাণ বাহিরে বের হয়ে আসে। এখন বিয়োগ করিয়া দেখা গেলো ১২-১০=২ আঙ্গুল। অতএব, দেখা গেল প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রতিনিয়ত প্রত্যেক দমে দমে পরম আয়ু ঘাটতি হইতেছে ২ আঙ্গুল। এই জন্য আমাদের মৃত্যু অনিবার্য। তাহা হলে দেখা গেল চুপচাপ বসে থাকলে ২ আঙ্গুল ঘাটতি হইতেছে। কিন্তু মানুষতো চুপ চাপ বসে থাকতে পারে না। মানুষ একটি কর্মব্যস্ত জীব। হাটা-হাটি, চলা-ফেরা, ছুটা-ছুটি প্রত্যেকটি মানুষের স্বভাব। তারপর যৌবনে কামবানে জর্জরিত হইয়া কামবাসনা পূর্ণ করার জন্য নারীর সঙ্গম, তারপর দিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য রাত্রি নিদ্রা। এবার তাহা হলে দেখা গেল আমাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হোক না কেন আমাদের প্রাণ বায়ু প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে কি পরিমাণ পরম আয়ু ঘাটতি করিয়া আমরা সবাই মৃত্যুর দিকে কত দ্রুত ছুটে চলছি।
এখন আমরা শাস্ত্রে প্রবেশ করিয়া দেখি। কিভাবে আমরা তাড়াতাড়ি পরম আয়ু বিনাশ করিয়া মৃত্যুর দিকে ধাবিত হইতেছি। শাস্ত্রে প্রমাণ মানুষ যখন চুপ চাপ বসিয়া থাকে তখন প্রাণ বায়ু ভিতরে যার ১০ আঙ্গুল পরিমাণ এবং বাহিরে আসে ১২ আঙ্গুল পরিমাণ। এতে ২ আঙ্গুল পরিমাণ ঘাটতি প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাসে। কি কি কার্যে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস কি পরিমাণ ভিতরে এবং বাহিরে আসা যাওয়া করে তা নিচে উল্লেখ করিলাম...
*চুপ চাপ বসিয়া থাকিলে শ্বাস ১০ আঙ্গুল ভিতরে যায়, ১২ আঙ্গুল বাহিরে আসে।
*কথা বলা ও খাওয়ার সময় শ্বাস ১০ আঙ্গুল ভিতরে যায়, ১৮ আঙ্গুল বাহিরে আসে।
*ঘুরা-ফেরার ও হাঁটা-হাঁটির সময় শ্বাস ১০ আঙ্গুল ভিতরে যায়, ২৪ আঙ্গুল বাহিরে আসে।
*বড় কোন কাজ বা দৌড়াদোড়ির সময় শ্বাস ১০ আঙ্গুল ভিতরে যায়, ৩৬ আঙ্গুল বাহিরে আসে।
*রাত্রি নিদ্রা কালের সময় শ্বাস ১০ আঙ্গুল ভিতরে যায়, ৬৫ আঙ্গুল বাহিরে আসে।
*স্ত্রী সহবাস কালের সময় শ্বাস ১০ আঙ্গুল ভিতরে যায়, ১০০ আঙ্গুল বাহিরে আসে।
তাহলে দেখা যায় প্রত্যেক বার শ্বাস ভিতরে যায় মাত্র ১০ আঙ্গুল। এবার ভেবে দেখুন প্রতিনিয়ত আমাদের ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক কত দ্রুত আমাদের পরম আয়ু বিনাশ করিয়া মৃত্যুর দিকে ধাবিত হইতেছি। ভাবিলে অন্তর কেঁপে উঠে। আমার তথ্য মিথ্যা নয়। ইহা শাস্ত্রে প্রমাণ। তবে ভয়ের কিছু নাই। ইহা দুনিয়াকামী মানুষের অবস্থা। কিন্তু আল্লাহ্ প্রেমিক বান্দারা যদি একজন পূর্ণ আত্মজ্ঞানী কামেল মুর্শিদের চরণে গিয়া আত্মসমর্পন করিতে পারে, তবে দয়াল গুরু ভক্তকে দমের সাধন শিক্ষা দিয়া ভক্তের পরম আয়ু রক্ষা করার কৌশল বাতায়ে দিবেন। আর পরম আয়ু রক্ষা করা তেমন কঠিন সাধন নয়। গুরু কৃপা করিলে সব ভক্তই ইহা করিতে পারবে। ইনশাল্লাহ্।